লেখকঃঅথই নুরুল আমিন

গ্রামের বাড়ি বরিশালের হিজলা থানার দক্ষিণের শ্রীরামপুর গ্রামে। পারুলের বয়স 14-15। বাবা দিন মজুর মেরাজ সিকদার। একদিন তাদের ভালো অবস্থা ছিল। দু-দুবার নদী ভাঙ্গনের ফলে আজ মেরাজ সিকদারের ঘরে খাবার নেই। জমি নেই বলে কেউ কিছু বাকি বা ধার দেয় না। এমন অবস্থায় আজ দুদিন ধরে ভাতের হাড়ি চুলায় চড়ছে না।

পারুলের মায়ের বেশ কিছুদিন ধরে জ্বর, সকালে ভাল হলে বিকালে আর বিকালে জ্বর না এলে রাতে আসে। বেশ কয়েকদিন ধরে পাশের বাড়ির মোমেনার সাথে পারুলের ঢাকায় আসার কথা। ঢাকায় আসার কথাটা যেন মেরাজ সিকদারের কাছে ভারী পাথরের মত লাগে। এতো আদরের মেয়েটি ঢাকায় চলে যাবে। একথা পারুলের বাবা যেন ভাবতেই পারেনা।

তারপর আবার বিকালে মোমেনা আসে পারুলের বাবাকে বলে মামা আমি তো কাল পরশু ঢাকা চলে যাব। পারুলের ব্যাপারে কিছু তো বললেন না। মোমেনা ও চায়। পারুলের একটা কর্ম হোক।
অনেক ভেবে চিন্তে মেরাজ সিকদার রাজি হল, ছোট-বড় তিনটা মুরগি বিকালের বাজারে বিক্রি করে যা টাকা পেল পরের দিন মোমেনার হাতে ঐ টাকাগুলো উঠিয়ে দিল এবং পারুলের বাবা অনুমতি দিল।
তার পরের দিন মোমেনা তার স্বামী আর পারুল ঢাকার দিকে রওনা দিল।

রাজহংস লঞ্চে আসলো। এবং মোমেনারা রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে টিক্কাপাড়া বস্তিতে থাকে। সমস্যা হল ঘরের মালিকের আপত্তি উঠানো। আর একজন বাড়তি লোক থাকতে দিবে না। তাই মোমেনা অন্য এক মহিলার সাথে পারুলকে দিলো ম‍্যাচে।

গার্মেন্টসে চাকুরি নিল পারুল। তারপর দিন যায়, মাস যায়, বছর পার হল। ঈদ এল বাড়ি যেতে চাইলো পারুল কিন্তু টাকার সমস্যায় তার আর যাওয়া হলোনা। বাবা মা ভাই বোন স্বজন দেখার জন‍্য পারুলের অনেক আশা ছিলো। এক সপ্তাহের ছুটি। এই ছুটির সুবাদে ম্যাচের অন্য একটা ছেলের সাথে পারুলের ভাব হয়ে যায়। ছেলেটি রিকশা চালক, ড্রাইভারি শিখবে প্রাইভেট গাড়ির, সেখানেও সময় দেয়। একপর্যায়ে ম্যাচের মহিলা রাশিদা যখন জানতে পারে আগের দিন বিকেলে পারুল আর শফিক দুজন ঘুরতে গিয়েছিল সংসদ ভবনের আঙ্গিনায়।

তখন রাশিদা দুজনকে খুব বকাঝকা করে। একপর্যায়ে ছেলেটি বলে, আমি পারুলকে বিয়ে করবো। পারুল এখন অনেক সুন্দরী হয়েছে। প্রস্তাবের পর রাশিদা মোমেনাকে বিষয়টি জানায়। মোমেনা দেশে তার বাবাকে এই মর্মে একটি চিঠি লিখে এবং আসতে বলে। দিন দরিদ্র পিতা 4-5 শত টাকা কোথায় পাবে। তাই সে খবর দিল মোমেনা তোমরা যা ভালো বুঝ তাই করো। পারুলের বিয়ে হয়ে যায়।
মোমেনার বাসার পাশে ভাড়া নেয় একটি রুম।

এখানে পারুল ও শফিক থাকে। পারুল পরের মাসেই গর্ভবতী হয়ে পরে। ছেলেটি রিকশা চালাতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার পর তার জ্বর হয় এবং প্রায় 10 দিন স্থায়ী হওয়ায় শফিক ঋণী হয়ে পরে। যে ড্রাইভার শফিককে গাড়ি চালানো শেখায় সেই ড্রাইভারকে কিছু টাকা দিতে হয়।ঘর ভাড়া আটকে গেল দুমাসের।

পারুলের সংসার জীবন স্থায়ী হলো ঢাকায় মাত্র সাত মাস, পারুল অনাহারে-অর্ধাহারে খুবই অসুস্থ হয়ে পরে। শফিক হয়ে পরে ঋণী এক পর্যায়ে পারুল বলে আমাকে তুমি বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দাও। শফিক পরের দিন সারাক্ষণ রিকশা চালিয়ে 100 টাকা আয় করে এবং মোমেনার কাছ থেকে 50 টাকা ধার নেয়। 150 টাকা দিয়ে পারুলকে দেশে পাঠায়।

ঋণের টাকা পরিশোধ করতে থাকে শফিক। পারুল যাওয়ার সময় শফিক বলেছিল সপ্তাহ পর কিছু টাকা পাঠাবে। কিন্তু তা আর হয়নি। পারুল ঢাকা থেকে বাড়ি আসার সময় যেমন তিনদিনের অনাহারী থেকে এসেছিল। দরিদ্র বাবার বাড়িতে গিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটতে লাগল। এভাবে দির্ঘদিনের অনাহারে অর্ধহারে অপুষ্টির কারনে পারুল জন্ডিস সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দিনের পর দিন আরো দুর্বল হয়ে পরে।

একদিন পারুল সন্ধ্যার দিকে পেটে ব্যথা অনুভব করে এবং তার মাকে তার অসুবিধার কথা বলে। তার মা বিষয়টি বুঝতে পারে এবং সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাড়ির কল্পনার মাকে নিয়ে আসে। পারুলের গর্ভ থেকে জন্ম নেয় এক মেয়ে শিশু কিন্তু পারুল আর আমাদের মাঝে নেই। কন্যা শিশুটি ভূমিষ্ট হওয়ার কয়েক মিনিট পরেই মারা যায় পারুল। আর দুধের শিশুটি নিয়ে পারুলের মা-বাবা আজ আরো সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন যাপন করতে লাগলো।
এর মধ‍্যে শফিক আর কোনো দিন শশুর বাড়ি যেতে পারিনি অর্থ সংকটের কারনে। সখের বসবতি ভুলের খেসারত দিল দুজনেই।
লেখক বলে সঠিক সিদ্ধান্ত ছাড়া পুষ্টিত বা সুন্দর জীবনযাপন সম্ভব নয়। সবাই ভালো থাকুন।
লেখক : সমাজ চৈতন্য ও অধঃপতন বিশেষজ্ঞ।
(বাস্তব গল্প অবলম্বনে )